সিলেট প্রতিনিধি
সিলেটে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানো, অল্প বয়সে বিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অবাধ যোগাযোগের সুযোগ, স্বামীর দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা, পরকীয়া ইত্যাদি বিবাহবিচ্ছেদের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এই প্রবণতা রোধে পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন দৃঢ় করার ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।
চলতি বছর প্রথম আট মাসে নগরীতে বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে ২৫৩টি। যার অধিকাংশই করা হয়েছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। ২৫৩টির মধ্যে ১৩৯টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনই নারীর। শুধু সিলেট জেলায় আট মাসে তালাক হয়েছে ২ হাজার ১৩৯টি। সেক্ষেত্রেও এগিয়ে নারীরাই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বেশি বিবাহবিচ্ছেদের নেপথ্যে রয়েছে পরকীয়ার মতো অবৈধ সম্পর্ক। ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজেদের সিদ্ধান্তে বিয়ে করছেন তরুণ-তরুণীরা। পরিবার শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেও কোনোকিছুর দায়ভার নিচ্ছে না। ফলে পারিবারিক কলহ বাড়ছে। কমছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অনুশাসন মানার প্রবণতা। বিচ্ছেদ হচ্ছে বেশি।
কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্সে সন্তানদের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসছে। দেখা দিচ্ছে মানসিক সমস্যাও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ। পরকীয়া ছাড়াও শারীরিক অক্ষমতা, পারিবারিক কলহ এবং যৌতুককেও বিবাহবিচ্ছেদের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণে পারিবারিক সচেতনতার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে।
জানা যায়, সিলেট সিটিতে আট মাসে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মোট আবেদন জমা পড়ে ২৫৩টি। গত জানুয়ারিতে স্বামী কর্তৃক ৩২ ও স্ত্রী কর্তৃক ৫০; ফেব্রুয়ারিতে পুরুষ ৭ ও নারী ১৩; মার্চে পুরুষ ১৬ ও নারী ১৪; এপ্রিলে পুরুষ ১৫ ও নারী ১৪; মে মাসে পুরুষ ৯ ও নারী ১৪; জুনে পুরুষ ১৮ ও নারী ১৬; জুলাইয়ে পুরুষ ৮ ও নারী ১০ এবং আগস্টে পুরুষ আবেদন করেছেন ৯টি ও নারী আবেদন করেছেন আটটি। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশন বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করেছে ৫২টি।
জেলা বিবাহ রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট বিবাহ নিবন্ধনের সংখ্যা ২০ হাজার ৯২৩টি। বিপরীতে তালাকের সংখ্যা ২ হাজার ১৩৯টি।
নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা নাসরিন আক্তার বলেন, বিয়ে করেছিলাম ভালোবেসেই। দুই বছরের মাথায় জানতে পারি স্বামীর একাধিক বিয়ের কথা। তার পরিবারকে জানালে উল্টো আমার ওপর নির্যাতন শুরু করে। বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাই। প্রথমে আদালতের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছিলাম। পরে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সালিশের মাধ্যমে সমাধানে যাই। কিন্তু সেখানেও সমাধান না হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে কোর্টে লড়ছি।
তিনি আরও বলেন, স্বামী ডিভোর্স লেটার দেননি, বরং আমাকে হয়রানি করার পাঁয়তারা করেছে। সন্তানদের পড়ালেখার জন্য জন্মনিবন্ধনও করাতে পারছি না। এ বিষয়ে তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সহযোগিতা পাইনি। সে এখন আত্মগোপনে আছে। তার অন্য স্ত্রীরাও তাকে খুঁজছেন। এসব কাজে তার পরিবার বিশেষ মা-বোন তাকে ইন্ধন দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী।
সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, নারীরা আগের তুলনায় কর্মমুখী হওয়ার কারণে তাদের সক্ষমতা বাড়ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর শ্রমের ন্যূনতম স্বীকৃতিও দেয় না পুরুষরা। প্রেমের বিয়েতে স্বামী-স্ত্রী সমবয়সী হলে ঝামেলা হয় বেশি। কে কার অধীনে থাকবে, কেন থাকবে এরকম ইগোকেন্দ্রিক তুচ্ছ ইস্যুতেও ডিভোর্স হচ্ছে। প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে পুরো সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার দায় বর্তায় স্বামী-স্ত্রীর দুজনের ওপর। অন্যদিকে, সামাজিক বিয়েতে বর-কনে ছাড়াও তাদের পরিবার এবং আশপাশের মানুষের মধ্যে বন্ধন তৈরি হয়। ফলে সেখানে জবাবদিহিতাও বেশি থাকে। দিন দিন আমরা অসহনশীল হয়ে উঠছি।
এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ফজিলাতুন নেসা জানান, আমার কাছে মনে হয় সিলেটে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথম কারণ পরকীয়া। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ পুরুষ প্রবাসী। নারীরা একাকিত্ব ঘোচাতে পরকীয়ায় জড়াচ্ছেন।
আরেকটি কারণ হলো পারিবারিক চাপ। দাম্পত্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকাও অন্যতম কারণ। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক এবং অর্থনৈতিক কারণেও বিচ্ছেদ হয়। ছেলের পরিবার ছেলেকে যেমন দেখে, মেয়েকে তেমন দেখে না; তাই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। সম্পর্ক দুধরনের, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিপীড়নমূলক। উভয়কেই এগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিটি সম্পর্কেরই একটা সীমানা থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ নারী-পুরুষ তা জানে না। এ বিষয়গুলোতে সচেতন থাকা জরুরি।
বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমদ রিহাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্বামীরা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হয় সিলেটে। এখানে টেলিফোনের মাধ্যমে বিয়ের ঘটনা বেশি। তার ওপর দীর্ঘদিন দেশে না আসার কারণেও বিচ্ছেদ হয়। মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এখন বেশি। আবার বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেকে পরকীয়া ও সামাজিক অস্থিরতায় জড়িয়ে পড়েছেন। ডিপ্রেশন বা প্রেমঘটিত কারণ এবং পারিবারিক কলহেও বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত।
তিনি আরও বলেন, কিছু ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার নারীর ক্ষমতায়নে প্রভাব ফেলে। অনেক সময় শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়রা নবদম্পতির সম্পর্কে নানাভাবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলে সম্পর্কে টানাপোড়েন ও অস্থিরতা তৈরি হয়, যা পরবর্তী সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়। আবার উচ্চশিক্ষিত সমাজ ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পরিবারে সময় দিতে পারে না। বিবাহবিচ্ছেদ ঠেকাতে ফ্যামিলি কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শ দেন তিনি। সামাজিক বাধা পেরিয়ে মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে বলেন দম্পতিদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান যুগে ছেলেমেয়েরা একে-অন্যের ওপর ভরসা করেন না। সবাই নিজেদের স্বাধীনতা চান। উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, নিজেদের অঢেল অর্থ সম্পদ আছে, বিচ্ছেদ হলে সমস্যা নেই। আর নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফারাক বেশি। ফলে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। আবার মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জায় ঘর ভাঙতে রাজি নন।
গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তুমপুর ইউনিয়নের দায়িত্বরত নিকাহ রেজিস্ট্রার মাওলানা মো. আমিরুল হক বলেন, ৯ মাসে বিয়ে হয়েছে ১৯৬টি, বিচ্ছেদ হয়েছে আট দম্পতির। বিছনাকান্দি ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ১৪৬টি এবং তালাক হয়েছে ১২টি। কী কারণে বিচ্ছেদ—জানতে চাইলে তিনি জানান, সবগুলোর কারণ পারিবারিক কলহ। তবে গতবারের তুলনায় বিচ্ছেদের পরিমাণ কম।
জেলা কাজি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজি আব্দুল জলিল খান বলেন, সিলেট নগরীতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন অনেক। তবে নগরী বলেন আর জেলা—সব জায়গায় মেয়েদের আবেদনের সংখ্যা বেশি। বিবাহবিচ্ছেদের মূল কারণ শারীরিক অক্ষমতা, পারিবারিক কলহ, যৌতুক ও পরকীয়া হয়ে থাকে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিবার থেকে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
Leave a Reply